ডাক্তাররা কেন টেস্ট করেন? কারনে না অকারনে? নাকি কমিশনের জন্য?
প্রথমে 2 টি ঘটনা বলি...
১। একবার 2 দিনের জর নিয়ে ৩০ বছর বয়সী একজন রোগী আমাকে দেখালেন। আমি দেখার পর মনে হল ভাইরাল ফেভার। রোগীর প্রেসার কম আর খেতে পারছে না তাই রুটিন টেস্ট দিয়ে ভর্তি করলাম। ভর্তি হবার 2 ঘন্টা পর (তখনও রিপোর্ট আসেনাই) রোগী হঠাত খারাপ হয়ে গেল। রোগী খুবই restless, প্রেসার 200/120, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, রোগীকে icu নেয়া হল, কিছুক্ষণ পর (৩০ মিনিট এর মধ্যে) রোগী মারা গেল। ওই সময় আমি আর ভাগ্যক্রমে বিধু স্যার সেখানে উপস্থিত ছিলাম। রোগী মারা যাবার পর রিপোর্ট আসল, আমরা দেখলাম platelet count 30000.রোগীর লোকের কাছে আবারো ইতিহাস নেয়া হল। রোগীর লোক বলল গতকাল অনেক জর হবার পর তাকে diclofen ট্যাবলেট জর কমানোর জন্য দিয়েছিল গ্রামের ঔষধের দোকানদার। রোগীর platelet count কম ছিল, তার উপর diclofen খেয়ে ব্রেনে রক্তক্ষরন হয়ে রোগী মারা গেছে। শিক্ষনীয় হচ্ছে- platelet count দেখে তা নরমাল হলে তারপর NSAID দেয়া উচিত।
২। ৩/৪ দিন আগে একজন ডায়াবেটিসের রোগী জর নিয়ে আমাকে দেখালেন, আমার মনে হল তার প্রসাবে ইনফেকশন, আমি প্রসাবের পরীক্ষা দিলাম, কিডনীর টেস্ট আগে করা ছিল, নরমাল ছিল তাই আর করালাম না। রোগী বাসা গেলো। ২ দিন পর রোগী হাস্পাতালে ভরতি হল, রোগীর তেমন কোন উন্নতি নেই, C/S দেখার পর এ্যান্টবায়োটিক পরিবরতন করব, ভাবলাম কিডনী কেমন আছে দেখি,আগের রিপটটা খুজে পেলাম না, তাই কিডনীর পরীক্ষাটা করতে দিলাম, রিপট আসার পর আমার কোনভাবেই সঠিক মনে হয় নাই, কারন S. creatinine 12 mg/dl ছিল, ল্যাবে বললাম রিপিট কর, রিপট একই আসল। S. electrolyes করে দেখলাম hyperkalaemia আছে। রোগীর গতকাল ডায়ালাইসিস করা হয়েছে। তাহলে এসব টেস্ট কি অকারনে করা হয়েছিল???শিক্ষনীয় হচ্ছে-ডায়াবেটিস/হাইপ্রেসারের রোগীর মাঝে মাঝে (অন্তত ৬ মাসে ১ বার) এবং যে কোন acute illness এ ভাইটাল অরজান গুলো চেক করা উচিত। (এই রোগীকে প্রথমেই কিডনীর পরীক্ষা দিলে, রোগী বলত সামান্য জর নিয়ে এলাম আর ডাক্তার এত গুলো পরিক্ষা অকারনে দিল, আর রোগী যখন খারাপ হয়ে গেল তখন রোগির লোকের ভাষ্য-আপনি আগে কেন কিডনী টেস্ট করালেন না)।
এবার আসি পরীক্ষা-নীরিক্ষায়। আমরা সাধারনত কয়েকটি পরিক্ষাকে রূটিন বলে থাকি। এগুলো হল-CBC, RBS, S. creatinine, Urine R/E, ECG (after 40 years).
CBC করে আমরা অনেকগুলো তথ্য পাই, যেমন-শরীরে রক্তের পরিমান কেমন, শরীরে কোন ইনফেকশন আছে কিনা, ব্লাড ক্যন্সার আছে কিনা এবং platelet count কেমন, যা কমে গেলে শরীর থেকে রক্ত ক্ষরন হতে পারে। যে কোন রোগির এই টেস্ট না করে তার শরীরে সারবিক অবসহা বুঝা সম্ভব না।
RBS এই পরীক্ষা দিয়ে কারো ডায়াবেটিস আছে কিনা তা স্ক্রেনিং করি। ১৮ বছর পর এই পরিক্ষা বছরে অন্তত একবার করা উচিত, তবে যাদের বাবা-মায়ের ডায়াবেটিস আছে আর যাদের ওজন বেশি তাদের বছরে অন্তত ২ বার (৬ মাস পর পর) করা উচিত। কারো যদি ডায়াবেটিস untreated or uncontrolled থাকে তবে তার কিডনী নষ্ট হয়ে যেতে পারে, হারট এ্যাটাক, ষ্ট্রোক, অন্ধত্ত সহ আরো অনেক জটিল রোগ হতে পারে।
S. creatinine এই টেস্ট দিয়ে আমাদের কিডনী ঠিক আছে কিনা দেখা হয়। কিডনী রোগ যত তারাতারি ধরা পরবে তত ভালো হবার সম্ভবনা বেশি। যাদের ডায়াবেটিস/হাইপ্রেসার আছে তাদের কিডনী নষ্ট হবার সম্ভবনা অনেক বেশি। তাছাড়া যে কোন ধরনের NSAID, কিছু প্রেসারের ঔষধ, কিছু ডায়াবেটিসের ঔষধ, বাত রোগের ঔষধ, ক্যান্সারের ঔষধ দেয়া না দেয়া, কি ডোজে দিতে হবে তা নিরভর করে S. creatinine এর উপর। বছরে অন্তত একবার S. creatinine করা উচিত।
Urine R/E এটি খুবই সাধারন একটি পরীক্ষা কিন্তু খুবই ইনফরমেটিভ, এটি দিয়ে প্রসাবে ইনফেকশন আছে কিনা, কিডনীতে কোন সমস্যা আছে কি না, কিডনীতে কোন পাথর আছে কিনা, ডায়াবেটিস আছে কিনা ইত্যাদি জানা যায়। এছাড়াও কারো কিডনীতে সমস্যা কেবল শুরু হয়েছে কিনা (যা চিকিতসায় ভালো করা সম্ভব) তাও বোঝা যায় (প্রসাব দিয়ে যদি protein যায় তবে বুঝতে হবে কিডনীতে সমস্যা শুরু হয়েছে)।
ECG গত সপ্তাহে একজন ডায়াবেটিস রোগী দেখেছিলাম, যিনি ঔষধ খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন, ভেবেছিলেন ঔষধ খাবার আর দরকার নেই, তার ডায়াবেটিসের পরিক্ষা, কিডনীর পরীক্ষা আর ECG করতে দিলাম, ECG তে Recent anterior MI আসল, ইকো করার পর Ischaemic cardiomyopathy আসল। ডায়াবেটিস ও হাইপ্রেসারের রোগীর বছরে অন্তত একবার ECG করা উচিত। কারন Heart attack বয়স্ক এবং ডায়াবেটিসের রোগীর বুকে কোন ব্যাথা ছাড়াই হতে পারে।
আমার নন-মেডিকেল বন্ধুদের বলছি কেউ যদি এসব টেস্ট (CBC, RBS, S. creatinine, Urine R/E, ECG) করেন, তাহলে ভাববেন না আর জীবনেও এসব করা লাগবে না, আপনি যদি আজ সব টেস্ট করেন আর কালকেই যদি আপনার বুকে ব্যাথা হয় তবে আবারো ECG করতে হবে। দয়া করে ভুল বুঝবেন না। ডাক্তার যে টেস্ট করতে দেন তা আপনার জন্যই, আপনার চিকিতসার জন্যই।
আমি আমার ছাত্র-ছাত্রীদের বলছি, তোমরা কোন রোগীকে চিকিতসা দেবার আগে সবসময় চেষ্টা করবে রুটিন পরীক্ষাগুলো করাতে, কারন একটা জিনিস মনে রাখবে, মেডিকেল সাইন্সে হিরো কখনি তুমি হতে পারবেনা, কিন্তু তোমার এক ভুলে তুমি জিরো হয়ে যাবে। রোগীকে পরিক্ষা করাতে বলবে, রোগি যদি করতে না চায়, চিকিতসা দিবে, রোগী ভালো না হলে তোমাকে বেশি চারজ করবে না, কারন চিকিতসার দরকারী পরিক্ষাতো তারা করান নাই। কিন্তু তুমি যদি পরীক্ষা না করাতে দাও আর রোগীর উন্নতি না হয় বা ঔষধের কোন সাইড ইফেক্ট হয় তবে তোমার ঘাড় ধরে বলবে আপনি কেন পরীক্ষা না করিয়ে চিকিতসা দিলেন??
সবার জন্য বলছি আপনি আপনার টিভি, ফ্রিজ, বাইক, গাড়ি মাঝে মাঝে চেক করেন, সারভিসিং করেন, নিজের শরীরটার বছরে ১ বার সারভিসিং করেন, বছরে ১ বার CBC, RBS, S. creatinine, Urine R/E, ECG, Fasting lipid profiles করে একজন ফিজ়িশিয়ানকে দেখান। এসবের জন্য ২০০০ টাকার বেশি খরচ হবে না। নিজের জন্য বছরে অন্তত ২০০০টাকা খরচ করুন, তাহলে ভবিষ্যতে অনেক ভালো থাকবেন।
No comments:
Post a Comment